কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে যখন বিশ্বব্যাপী বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল ঠিক সেই সময় দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও চীন জড়িয়েছে সামরিক সংঘাতে। গত সোমবার লাদাখের সুউচ্চ পর্বত মালায় গালওয়ান নদীর পূর্ব পার ধরে যখন ভারতীয় সেনার বিহার রেজিমেন্টের একটি পেট্রোল পার্টি পেট্রোলিংয়ে বেরিয়েছিল সেসময় চীনা সেনাদের সাথে তাদের তীব্র সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৬২ সালের পর এটি দু'পক্ষের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাতের ঘটনা। প্রায় আট ঘন্টা ধরে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলেছিল। এতে, অন্তত ২৩ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে এখনও হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জানানো হয়নি। ভারত ও চীন পাশ্ববর্তী এই দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা এবার নতুন নয়। ১৯৬২ সালে তাদের মধ্য যুদ্ধ হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে সিকিমে নাথুলার কাছে এই দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। ১৯৭৫ সালে অরুণাচল সীমান্তে ভারত ও চীন সংঘাতে জড়ায়। এই সংঘাতে কয়েকজন সৈন্য নিহত হন। এরপর ২০১৭ সালে ডোকালামে ভারতীয় ও চীনা সেনারা হাতাহাতির মত ঘটনায় জড়িয়েছিল। তবে, পূর্ববর্তী সংঘর্ষের চেয়ে এবারের সংঘাত দুই প্রতিবেশী দেশের সর্ম্পকে নতুন করে তিক্ততা বাড়িয়ে দিল। এই দুই দেশের সংঘাতের মূখ্য কারণ হচ্ছে সীমান্ত বিরোধ। ভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে বড় অংশ রয়েছে লাদাখে। বাকি অংশ উত্তর- পূর্ব ভারতের সিকিম এবং অরুণাচলে। এসকল সীমান্ত এলাকা নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে মাঝে মাঝে সংঘাত হয়। তবে, আশার কথা হচ্ছে, দুইপক্ষই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হওয়া এবং পারস্পরিক বাণিজ্যিক নির্ভরশীলতার কারণে তারা বড় দ্বন্দ্বে জড়ায় না।
তবে, এবারের সংঘাতের পিছনে সীমান্ত বিরোধ ছাড়াও আরো কিছু কারণ দৃশ্যমান হচ্ছে।
প্রথমত, গত আগষ্টে ভারত সরকার জম্মু-কাশ্মীরসহ লাদাখের ন্যূনতম স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে বিরোধপূর্ণ এলাকাটিকে নিজের করে নেয়। যেহেতু, লাদাখ নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের সর্ম্পক তিক্ত তাই জম্মু-কাশ্মীর ইস্যূতে নতুন করে পাকিস্তানের সাথে চীনও জড়িয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, করোনা পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বেকায়দায় থাকার জন্য এশিয়ায় শক্তিশূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই শক্তিশূন্যতার সুযোগ নিতে চায় চীন।
তৃতীয়ত, ভারত সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে নেপাল, শ্রীলঙ্কায় তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। পাশাপাশি, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান চীনা সমর্থনে ভারতকে সীমান্ত সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাকফুটে রেখেছে। এভাবে, চীন তার প্রভাব বলয় বিস্তার করতে চাইছে।
চর্তুথত, নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন বেইজিংকে নিয়ে যে হিসাব নিকাশ কষেছিল তা ভুল প্রমাণ করতে চায় চীন।
এসব কারণে, চীন লাইন অব এক্সুয়াল কন্ট্রোলে বিন্দুমাত্র ছাড় দিলো না ভারতকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমস্যা কি সামনের দিনগুলোতে বাড়বে না কমবে? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, চীন ও ভারত সাময়িকভাবে সংঘাতে জড়িয়ে থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে কোন যুদ্ধে জড়াবে না। কেননা, এতে দুই পক্ষের কম-বেশি ক্ষয় -ক্ষতি হবে। তাছাড়া, দুই পক্ষের মিত্রদেশগুলোও চাইবে না তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ুক।
চীন ও ভারত কোন যুদ্ধে জড়ালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। এ কারণে, বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটানের মত দেশগুলো চাইবে এই দুই পরাশক্তির স্থিতিশীল অবস্হা। কেননা, তাদের স্হিতিবস্হার উপর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক স্হিতিবস্হা নির্ভরশীল। তাছাড়া, কোভিড পরবর্তী বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা করা হচ্ছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য ভারত ও চীনের স্থিতিশীলতা জরুরী।
অতএব, বাহ্যিকভাবে আমরা যা কিছুই ভাবি না কেন ভারত ও চীন সরাসরি কোন যুদ্ধে জড়াবে না। ইতিমধ্যেই, আমরা দেখেছি দুই পক্ষেই কূটনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দও দুই পক্ষকে কূটনৈতিক সমঝোতার পরামর্শ দিয়েছে।
লেখকঃ মোঃ হাসান তারেক,
প্রভাষক,
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা।
0 মন্তব্য